করোনা পরিস্থিতিতে দিশেহারা পুরো বিশ্ব। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক ধনী দেশও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। অনেক দুযোর্গপূর্ণ অবস্থা মোকাবেলা করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জনজীবনের কথা মাথায় রেখে অবশেষ ৩১ মে থেকে বাংলাদেশের সকল অফিস, কারখানা সব চালু করে দেওয়া হলো। বাদ যায়নি পর্যটন এলাকাগুলো। কিন্তু সবকিছু চালু করে দিলেও চালু করা হয়নি শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
নয় মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, তাও কেউ জানে না। কারণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। লক্ষণও আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, করোনার বিস্তার রোধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত এবং প্রায় সব শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে বেশিরভাগ দেশে। কার্যত সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থাই এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক নানা পরিকল্পনার কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছি। কিন্তু করোনার এই সময়ে শিক্ষা নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে না। তবে আমরা যা দেখছি শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য সরকারও কম চেষ্টা করছেন না। যার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কিন্তু কথা হলো শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে আর গ্রামের বেশির ভাগ সে সুবিধার বাইরে। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে কিন্তু সেখানে উপস্থিতি ভালো নয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও সমমানের পরীক্ষা এ বছরের জন্য বাতিল করা হয়েছে। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা, এইচএসসি পরিক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এসএসসি পরিক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষা নিয়ে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেই। স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেই। সব মিলিয়ে পড়াশোনা ও পরীক্ষা ছাড়াই চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হলো, শিক্ষার্থীদের একাংশ পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়তে পারে। বাল্যবিবাহের হারও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তে পারে শিশুশ্রমও। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলে এর প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস করিয়ে পুরো টিউশন ফি নিচ্ছে। অভিভাবকেরা তা দিতে রাজি নন। বিপরীতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা বেতন না পাওয়া ও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। শুধু তাই নয় দেশের প্রায় ১০ হাজার কিন্ডার গার্ডেন স্কুল রয়েছে। সেখানে কর্মরত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের থেকে প্রাপ্ত টাকা থেকেই বেতন পেতে থাকেন। আজ সেসব শিক্ষকরা বেকার হয়ে ঘরে পড়ে রয়েছেন। লজ্জায় কারও কাছে চাইতেও পারেন না।
দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই ছুটির পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি খুলবে কি না আদো তা নিয়ে কোন আওয়াজ নেই। যদি ডিসেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে তাহলে হয়তো সিলেভাস সংক্ষেপ করে একটি মাত্র মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরের শ্রেণিতে উন্নীত করার ব্যবস্থা নেয়া যাবে; কিন্তু করোনা যদি আরও সময় ধরে থাকে? তাহলে কী হবে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম? সেই পরিকল্পনা নিয়ে শিক্ষার নীতিনির্ধারকরা কিছু কি ভাবছেন? কারণ করোনা নামের এই ভাইরাস দীর্ঘদিন পৃথিবীতে থাকতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, জীবন বাঁচানোর কার্যক্রম যেখানে পর্যাপ্ত নয়, সেখানে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা কতোটা স্বাভাবিক? কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, শিক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে জীবন বাঁচানোর জন্যই। শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা আগামীর করোনামুক্ত পৃথিবীতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাব না, কখনোই না। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে আমাদের সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা অত্যাবশ্যক।
তাছাড়া এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে লাখ লাখ যুবকের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। করোনার কারণে ১টি বছর ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে চলে যাওয়ার পথে কিন্তু যাদের চাকুরীর বয়স পার হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য কি কোন ব্যবস্থা নেওয়ার হয়েছে? যে শিক্ষার্থীর এই বছরে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে জীবিকার সন্ধ্যানে মাঠে নামার কথা তার ভবিষৎ কি? যে শিক্ষার্থী বছরের পর বছর সেশনজটে আটকে ছিলো তার ভবিষ্যৎ কি? কে দেখবে তাদের? তাদের জন্য কি কোন উদ্যোগ রয়েছে?
ইডেন কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহিয়া রহমান মাহি মনের আকুল কণ্ঠে জানান, দীর্ঘ দিন ধরে আমরা সেশনজটের ভোগান্তি পার করছিলাম। সবে যখন উত্তরণের পথে ঠিক তখনই করোনার থাবা। আমাদের শিক্ষা জিবন থেকে ৯ মাস পার হয়ে গেছে। আমাদের নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন উদ্যোগ দেখছি না। তাহলে আমাদের জিবন থেকে আরেকটি বছর হারিয়ে যাবে? সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ যেন সিমিত ভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হোক। তিতুমীর কলেজের ৪র্থ বর্ষের সোহেল রানা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, দির্ঘ্যদিন ধরে তাদের ফলাফল আটকে রয়েছে। কবে পাবে তার নিশ্চয়তা নেই। পরিবারের সোচনীয় অবস্থা। পড়ালেখা শেষ করে চাকরি খুঁজবো ভেবেছি কিন্তু সেই চাকরি তো দূরে থাক সার্টিফিকেট পাওয়ারও তো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না।
কিছুদিন আগে এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, কোভিডের সময় বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখার চেয়ে এগুলো খুলে রাখাই উপকারী। যেকোনো মূল্যে দেশজুড়ে স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়টি পরিহার করা উচিত ।
করোনার থাবায় আমাদের দেশে ও পুরো বিশ্বে বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কল্পনাও করিনি। কেউ আগে থেকে তা জানিও না। তাই সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সম্মিলিত চিন্তা নিয়ে। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অনেক। সরকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব এদের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেই জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহামারি বা জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যতো বেশি সময় শিশুরা বিদ্যালয় থেকে দূরে থাকে, তাদের বিদ্যালয়ে ফেরার সম্ভাবনা ততোটাই কমে যায়। করোনায় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ অবস্থা আমরা কোনোভাবেই চাই না। তাই করোনাকালে শিশুদের লেখাপড়া যাতে ঠিক মতো চলে, তার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেট দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আপনি আমাদের অভিভাবক। আপনি দেশকে নিয়ে যেভাবে বিশ্বের দরবারে পৌঁছেছেন তা ইতিহাসে বিরল। প্রিয় আপা আপনার সাথে আমরাও ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা যদি এভাবে অচল হয়ে থাকে তাহলে যে আমাদের স্বপ্ন পূরণে ব্যাঘাত ঘটবে। তরুণদের নিয়ে আপনি যে স্বপ্ন দেখেছেন তার ব্যাঘাত ঘটবে। এসেছেন লক্ষ তরুণ আজ বেকার হওয়ার পথে। দীর্ঘকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত না থাকায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি অনিহা তৈরি হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী যারা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যারা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা আজ ঘরবন্দি। তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ হাল ধরবে কারা? প্রিয় আপা (শেখ হাসিনা) এখনই সময় আপনার সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এই লক্ষ তরুণরা আপনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আপনি এমন করোনা পরিস্থিতিতেও দেশের অর্থনীতিকে যেভাবে সচল রেখেছেন তা বিশ্বের দরবারে প্রসংসনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি যদি সেভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করে দেন তাহলে এই লক্ষ তরুণরা তাদের ক্ষতি হওয়া দিনগুলো পুষিয়ে নিতে পারবে। তাদের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে। এরচেয়েও বড় কথা আমাদের দেশে শিক্ষার হার নিয়ে সে সুনাম রয়েছে তা বজায় থাকবে। প্রিয় আপা আপনার প্রতি বিনিত অনুরোধ স্বাস্থ্যবিধি মেনে, শিফট করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে আশাকরি দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিনষ্টের পথ থেকে ফিরে আসবে।
লেখক : সংবাদকর্মী ও শিক্ষার্থী