এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার:
নবগ্রামের জন্ম বেশি দিন হয়নি। জনসংখ্যা ও আয়তনের সবটুকু মিলেই উত্তর পাড়া আর দক্ষিণ পাড়া। ডিজিটাল মানচিত্রে দেখতে বদ্বীপের মতোই। জন্মের পূর্ব থেকেই উত্তর পাড়া যেখান থেকে নবগ্রাম আলাদা হয়েছে তাদেরই উত্তরসূরি। শুধুমাত্র ভৌগলিক বিভক্তির কারণে উত্তর পাড়া পূর্বের গ্রামের আনুগত্যের অংশীদার ও ভবিষ্যৎ পূর্বের গ্রামে ফিরে যাবার অলৌকিক স্বপ্ন দ্বারা তাড়িত ও প্রেষিত একটি বিশেষ ভাবনার মানুষের বাস। আর দক্ষিণ পাড়া সব সময়ই শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে আর আধুনিক বিশ্বায়নের পক্ষের পরিশীলিত চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী প্রায় সমসংখ্যক মানুষের বাস। আন্দোলন সংগ্রাম স্বাধীনতা দেশাত্মবোধ অসম্প্রদায়ীকতা অর্থাৎ বিশ্ব মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল আধুনিক মানুষ বিশিষ্ট দক্ষিণ পাড়া।
সংগত কারণেই নবগ্রামের জন্মের কিছু দিনের মধ্যে দুই পাড়ার সমন্বিত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। গ্রামের জনসংখ্যা, তাদের জীবনযাত্রা আগামীর ভাবনা, গ্রাম পরিচালনা ইত্যাদির সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কূটনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে। দক্ষিণ পাড়া চিন্তা চেতনায় এগিয়ে বলে তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করার ক্ষেত্রে উত্তর পাড়ারও কোনো আপত্তি থাকল না।
পণ্ডিতদের মাথায় আসলো জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জমি জমা উভয়েরই প্রায় অর্ধেক অর্ধেক। উত্তর পাড়া বলল আমাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষ এটা করতে চায় না। তাদের মত একটু ভিন্ন। এ বিষয়ে একমত হতে আমাদের একটু সময় দিতে হবে। উত্তর পাড়া সময় পেয়ে পূর্বের গ্রামের প্রভুদের সাথে কথা বলে একটি নতুন ফরমুলা পেয়ে গেল। তা হলো তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণে রাজি কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা সিদ্ধান্ত নিল এটির বিপরীতে হাঁটতে হবে এবং যতদ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা যাবে ততই দ্রুত দক্ষিণ পাড়াকে কুপোকাত করা যাবে।
তাই হলো। শুরু হলো নবগ্রামে জন্ম নিয়ন্ত্রণ। পরিচালনায় দক্ষিণ পাড়া। সংগত কারণে একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হবার পর দেখা গেল দক্ষিণ পাড়ার মানুষের ব্যবসা বাণিজ্য জমি জমা বাসস্থান ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে আর উত্তরপাড়ার জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় এসেছে যে প্রায় উত্তরপাড়ার তিনজনের বিপরীতে একজন দক্ষিণ পাড়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে।
টনক নড়ল দক্ষিণ পাড়ার। অবশ্য ততক্ষণে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু লোকজনও নবগ্রামে ঢুকে পড়েছে এমনকি দক্ষিণ পাড়ার প্রতিবেশী বন্ধু-গ্রাম তাদের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এমন যে তারাও মনে মনে কিছু লোকজনকে নবগ্রামে পাঠানোর বিষয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে।
এরকম বাস্তবতায় দক্ষিণ পাড়া প্রায় বিদিশা অবস্থায় কি আর করা। আবার দুই পাড়ায় মধ্যে মিটিং বসল। এবারও প্রসঙ্গ জন্মনিয়ন্ত্রণ তার সুফল কুফল এবং ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা। দেখা গেল দক্ষিণ পাড়ার বর্তমানে জনসংখ্যা উত্তর পাড়ার ২০% এরও কম। উত্তর পাড়া এবার বলল, শোনো তোমরা এই ২০ শতাংশ শিক্ষিত মানুষই এই গ্রাম চালাব আর এ রায় আমরা দিচ্ছি তোমাদের কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে তোমাদের সম্মান জানাতে হবে অবশ্যই।
রাজি দক্ষিণ পাড়া। প্রশ্নটি কী হবে সে টা সম্পর্কে জানার মতো আগ্রহ বেশি দূর আগানো গেল না জন-আধিক্যের বিবেচনায় উত্তর পাড়া বলল তোমাদের ঘরে আর কোনো হারমোনিয়াম বাজতে পারবে না কারণ আমাদের বেশির ভাগ মানুষ এটা ভীষণ অপছন্দ করে। কাজেই আমাদের পছন্দ অপছন্দের মূল্য তোমাদের দিতে হবে। নইলে জন্মনিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা আমরা আরও বেশি এটার বিপরীতে চলব। ভয়ের ব্যাপার। গ্রামটা কি আবার তাদের কাছেই ছেড়ে দিতে হয় কি না। কিন্তু ততক্ষণে আর কোনো বিকল্প পন্থা না থাকায় দক্ষিণ পাড়া রাজি হলো। কিন্তু সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে সাংস্কৃতিক চেতনার লালন পালন শিক্ষা দীক্ষার জ্ঞান, গরিমা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসাপ্রদায়িক চিন্তা দ্বারা চালিত এ মানুষগুলোর হারমোনিয়াম বন্ধ হলে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে জেনেও দক্ষিণ পাড়া রাজি হলো।
পুঁজিবাদের গণতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মেজরিটির কাছে এখন দক্ষিণ পাড়া অনেকখানি কোণঠাসা। দক্ষিণ পাড়া শুরু থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ চালু করেছে। কিন্তু যারা এটি বাস্তবায়ন করবেন না রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত না করায় আজ তাদেরই কণ্ঠরোধ হচ্ছে, চেতনায় পরিণত হচ্ছে। উদাসীনতা আর অন্যকে মূল্যায়ন না করার মতো মানসিকতার কারণে দক্ষিণ পাড়াই আজ মনস্তাত্ত্বিকভাবে আত্মসমর্পণ করার দ্বারপ্রান্তে।
উত্তর পাড়ার পূর্ণাঙ্গ স্বপ্ন পূরণ না হলেও প্রতিশোধ এবং নব প্রতিরোধ গড়ার ক্ষেত্রে উত্তর পাড়া অনেক খানিই সফল। যদিও দক্ষিণ পাড়া জনসম্মুখে তা বলতে পারে না কোনোভাবেই।
লেখক- সাবেক পুলিশ সুপার ফেনী।