১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |

মফস্বল সাংবাদিকতা ও আমার কিছু কথা

বাংলাদেশে সংবাদপত্র শিল্প পরিচালিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার তথা তথ্যমন্ত্রনালয় সংবাদপত্রের সাথে সংস্লিষ্ট সংবাদকর্মীদের বেতন কাঠামো নিধারণ করে ওয়েজবোর্ড নামক একটি কাঠামো করে দিয়েছে। বর্তমানে অষ্টম ওয়েজবোর্ড নামক কাঠামো চলছে। নবম ওয়েজ বোর্ডের কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই নবম ওয়েজবোর্ড কার্যকর হবে। উক্ত ওয়েজ বোর্ডে প্রত্যেক পদের জন্য বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা আছে। যা বাংলাদেশের ৯৫ ভাগ দৈনিক পত্রিকা মেনে চলে না। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মফস্বল প্রতিনিধিরা। সারা বাংলাদেশে গ্রামে গঞ্জে ৪৯০ উপজেলার ৬৪ জেলা থেকে তারা অত্যান্ত পরিশ্রম করে, অনেকটা অমানবেতর জীবনযাপন করে সংবাদ প্রেরণ করে থাকে। এই সংবাদ প্রেরণ করার জন্য তারা যে সম্মানি অষ্টম ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী পাওয়া উচিৎ তা পাচ্ছে না। তাদের যে একটা ইন্টারনেট বিল প্রয়োজন হয় তাও দেওয়া হয়না এবং কিছু কিছু ভূইফোঁড়,আন্ডারগ্রাউন্ড,অপেশাদার পত্রিকা আছে যেগুলো রাজনীতিবিদ, মাদক ব্যবসায়ী, ধান্দাবাজ যারা প্রকৃত সাংবাদিক না তাদের অর্থের বিনিময়ে সাংবাদিক বানিয়ে দেয়। চ্যানেল গুলোতেও চলছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। গুটি কয়েক নিউজ চ্যানেল বাদে বেশিভাগ প্রতিষ্ঠান মফস্বল প্রতিনিধিকে বেতন দেয় না এবং আন্ডার গ্রাউন্ড কিছু চ্যানেল প্রতিনিধি নিয়োগের সময় লাখ লাখ টাকা নিয়ে থাকে। এদিকে বছর জুড়ে তাদের বর্ষপূর্তি তাদের নানা সম্মেলন নানা অনুষ্ঠানের নাম করে প্রতিনিধিদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে সে অনুষ্ঠান উদযাপন করে।এইরকম নানা মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মফস্বল প্রতিনিধিরা কাজ করছে। কিছু নাম মাত্র পত্রিকা আছে যেগুলো ঠিকমত প্রতিনিধিদের আইডি কার্ড নিয়োগপত্রও দেয় না।কিন্তু আমাদের তথ্যমন্ত্রণালয়ের ডিএফপি থেকে অনুমোদন নিয়ে অষ্টম ওয়েজবোর্ড দেখিয়ে থাকে এবং ১ লাখ ,৫০ হাজার ডিক্লারেশন নিয়ে ২০০ কপি, ১০০ কপি বের করে। কিছু অক্ষ্যাত কুক্ষ্যাত লোক পত্রিকা বের করে সম্পাদক হচ্ছে এবং সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। আর প্রতিনিধিদের থেকে মাসে মাসে অর্থ কামাচ্ছে।

এসব বিষয়ে তথ্যমন্ত্রণালয়,পিআইবি, ডিএফপিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সজাগ হতে হবে। যারা সংবাদপত্র শিল্পে থাকবেন দৈনিক পত্রিকা সমূহ। সেসকল মালিকরা অষ্টম ওয়েজবোর্ড না মানা এবং মফস্বল সংবাদকর্মীদেরকে বেতন কাঠামো প্রদান না করা, যখন তখন ছাটাই , এগুলো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি চ্যানেল গুলোকে নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসতে হবে যাতে করে তারাও ওয়েজবোর্ড মেনে বেতন কাঠামো ঠিক রাখে।

আমার আজকের এই লেখায় মূল যে কথা তার মধ্যে আমি এখন প্রবেশ করছি। মফস্বল সাংবাদিকরা কোন বেতন পায় না সেটা আমি আগে উল্লেখ করেছি। সম্প্রতি একটি ভয়ংকর অশনি সংকেত তাদের জন্য আসতে যাচ্ছে ।তারা বেতন না পেলেও সরকারি যে বিজ্ঞাপণ আছে যেমন এলজিডি, রোর্ডস এন্ড হাইওয়ে, উপজেলা, জেলা পরিষদ, সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সহ নানা প্রতিষ্ঠান, উপজেলা জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারি অফিস থেকে অনুরোধ করে হাতে পায়ে ধরে বিজ্ঞাপণ নিয়ে ঢাকা নিজ নিজ অফিসে প্রেরণ করে। সেখান থেকে বিজ্ঞাপণ গুলোর যখন চেক হয় তখন ওই প্রতিনিধিরা ৩০-৪০% কমিশন পেয়ে থাকে। আমার ২০ বছরের গণমাধ্যমে চাকুরীর সুবাদে আমি দেখেছি এমনও কিছু প্রতিনিধি আছে যারা মাসে ১ লাখ টাকাও কমিশন তুলে। অনেকে এভাবে কোন ভাবে জিবন যাপন করে সংসার চালায়। সম্প্রতি গোপন সূত্রের ভিত্তিতে আমরা জানতে পেরেছি সারা বাংলাদেশের সরকারি বিজ্ঞাপণ সমূহ তা আর মফস্বলে থাকছে না। সমস্ত বিজ্ঞাপণ চলচিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তরে চলে আসছে। যে যে সংশ্লিষ্ট মফস্বলের সরকারি দপ্তর গুলো তাদের প্রয়োজনীয় বিজ্ঞাপণ সমূহ তারা ঢাকার ডিএফপিতে প্রেরণ করবে আর ডিএফপি ঢাকা থেকে বসে উক্ত বিজ্ঞাপণ গুলো বিতরণ করবে। এই বিতরণের ক্ষেত্রে অক্ষ্যাত কিছু পত্রিকা অনেক আগে এক সময় আমরা দেখেছি টাকা দিয়ে তারা বিজ্ঞাপণ নিয়ে যেত। এখন এই নিয়মটি পূণরায় আবার আসার পরে কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কোন সিস্টেমে পত্রিকা গুলোকে বিজ্ঞাপণ দেওয়া হবে তা এখনো আমরা জানিনা। কিন্তু আমার যে মূল কথা মফস্বল থেকে ঢাকাতে যে বিজ্ঞাপণ গুলো চলে আসছে, মফস্বলে ৬৪ জেলায় ৪৯০ উপজেলায় যেসকল আমার প্রতিনিধি ভাই বোনেরা আছে তাদের কি হবে? তারাতো আর মফস্বলের বিজ্ঞাপণের কমিশন পাবে না। তাহলে তারা সৎ ভাবে কিভাবে টাকা উপার্জন করবে? বিজ্ঞাপণ না দিলেতো এখনকার মত পত্রিকার মালিক সম্পাদকরা আর দাম দিবে না তাদের। কারণ এখন বেশির ভাগ পত্রিকা চলে মফস্বলের বিজ্ঞাপণ দিয়ে। মফস্বলের সাংবাদিকরা আগে বিজ্ঞাপণের কমিশন দিয়ে চলতো কিন্তু এখন তারা হয় চাঁদাবাজি করবে নাহয় যারা সৎ তারা এই পেশা থেকে সরে দাঁড়াবে। সৎ ভাবে চলতে গেলে তাদের অমানবেতর জিবন যাপন করতে হবে। এমত অবস্থায় আমার মত একজন ক্ষুদ্র মানুষের অনুরোধ আমাদের সাংবাদিক নেতৃত্ব , সাংবাদিক নেতা সমূহ, প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক সংগঠন সমূহ, ডিএফপি, পিআইবি বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন এমন যদি করা যায় ৬৪ জেলায় ৬৪টা সরকারি বিজ্ঞাপণ সেল থাকবে সেখান থেকে বিজ্ঞাপণ গুলো বিতরণ হবে। এক্ষেত্রে কিছু কিছু জেলায় দেখা যায় যাদের দাপট বেশি তারা বেশি বিজ্ঞাপণ পায় আর অনেকে পায় না। তাহলে এই নিয়ম চালু করলে জেলা উপজেলার সাংবাদিক গুলো সমান ভাবে বিজ্ঞাপণ গুলো পাবে। আর তা যদি না হয়ে বিজ্ঞাপণ গুলো ঢাকার ডিএফপিতে চলে আসে তাহলে একবার ভেবে দেখুন যেসকল সাংবাদিকরা এই বিজ্ঞাপণের কমিশন দিয়ে সৎ ভাবে জীবনযাপন করতো তাদের মত হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে যাবে। কেউ কেউ সাংবাদিকতার দাপট দেখিয়ে অসৎ পথে পা বাড়াবে। বিষয়টি আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অত্যান্ত বিচক্ষণ ভাবে সুদৃষ্টি দিবেন বলে আশা রাখছি।

এছাড়াও আমরা লক্ষ্য করে থাকি মফস্বলে জেলা উপজেলায় একাধিক প্রেসক্লাব, একাধিক সাংবাদিক সংগঠন, একেক উপজেলা জেলায় ৩,৪ টি করেও সাংবাদিক সংগঠন আছে। এই বিষয়টিও আমাদের জাতীয় সাংবাদিক সংগঠন গুলো আমলে আনা উচিৎ এবং সমস্ত জেলা উপজেলা প্রেসক্লাব গুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। যাতে করে ঘরে ঘরে প্রেসক্লাব খুলে অযোগ্য ব্যক্তিরা চাঁদাবাজি না করে। আর এত বেশি ২,৩ হাজার টাকার ভূইফোঁড় অনলাইন গুলো বের হয়েছে।ঢাকা শহরে হাটতে গেলে ধাক্কা লাগলেই বলে সাংবাদিক। এগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

পেশাদার সাংবাদিকদেরকে জায়গা করে দিতে হবে। আমাদের ঢাকায় যেসকল জাতীয় সংগঠন আছে তারা প্রত্যেকটা জেলা উপজেলায় কমিটি দিয়ে ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যাতে করে অপসাংবাদিকতা দখলদ্বারিত্ব না করতে পারে এবং ঘরে ঘরে ভুইফোঁড় সাংবাদিক সংগঠন যেগুলো গড়ে উঠেছে সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। তবে কিছু কিছু উপজেলায় সাংবাদিক সংগঠনগুলো ভালো কাজ করছে। তাদেরকে সুযোগ করে দিতে হবে। যারাই সাংবাদিক সংগঠন করবে তাদেরকে কাজের অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অত্যান্ত লজ্জা লাগে সাংবাদিকতার নাম করে ২ টাকার ডোমেন খুলে ঘরে বসে যোগ্যতা না নিয়েও মফস্বলে অনেক লোক সাংবাদিক পরিচয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঢাকায় অনেক অনলাইন আছে যারা টাকার বিনিময়ে অযোগ্য লোকদের গলায় আইডি কার্ড ঝুলিয়ে দেয় তাদেরকেও দমাতে হবে। না হলে এদের অপসাংবাদিকতার কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা হারিয়ে যাবে এবং অযোগ্য ভূয়া সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তিদের জন্য সাংবাদিকদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘ্রিণা জন্মাবে।

ইতিমধ্যে সরকার যে অনলাইনের নীতিমালা এনেছে সেটাকে সাধুবাদ জানাই। সেই সাথে অনুরোধ জানাই ভূঁইফোড় অনলাইন গুলো যেগুলো ঘরে বসে ল্যাপটপে নিয়ন্ত্রণ করে ধান্ধাবাজি করে সেগুলো যেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাংবাদিকতার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবকিছুকে একটা নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে ।

পরিশেষে আমি আবারও জেলা ভিত্তিক সরকারি বিজ্ঞাপণ গুলো সুশৃঙ্খল ভাবে বিতরণের অনুরোধ জানাচ্ছি। যাতে করে আমাদের মফস্বলের সাংবাদিকরা অসৎ পথে পা না বাড়ায়। তাদেরও জীবণ আছে। তাদেরকে কোন প্রতিষ্ঠান বেতন দেয় না তাহলে এই বিজ্ঞাপণ গুলো থেকে যদি কয় টাকা তারা না পায় তাহলে তারা চলবে কিভাবে? তাই মফস্বল সাংবাদিকদের বাঁচাতে হলে আমার মত ক্ষুদ্র মানুষটির এই ছোট্ট মতামতটি আমলে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক: ড.সাজ্জাদ হোসেন চিশতি
একজন ক্ষুদ্র গণমাধ্যম শ্রমিক

(Visited ২৫২ times, ১ visits today)

আরও পড়ুন

মহররম ঈমানী শোক ও ঈমানী শপথের মাস, আনন্দ উদযাপনের নয় – আল্লামা ইমাম হায়াত
ভাগ্য প্রক্রিয়া ও বরকতময় লাইলাতুল বরাত – সৈয়দ আল্লামা ইমাম হায়াত
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ৬ টি সংস্কারের দাবী
উন্নয়নের নামে দুর্নীতি আগামীর নগরপিতার কাছে এমন উন্নয়ন চাই না
করোনা কালে কর্মী থেকে যন্ত্রে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো
করোনায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত কোন পথে
ধর্মের নামে ধর্মের ছদ্ধবেশে অধর্ম উগ্রবাদের উত্থান
পেঁয়াজের দামে হঠাৎ এতো ঝাঁজ কেন? এর দায় কার?